Tuesday, 22 May 2018

■একটা মধ্যবিত্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের গল্প■

■একটা মধ্যবিত্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের গল্প■

লেখার শিরোনাম দেখে হয়ত বুঝেই গেছেন ভিতরে মটিভেশন কিংবা পড়াশুনার লেকচার দিব।লিখার বিষয়বস্তুর কাছাকাছি আপনি।আপনি যদি সেকেন্ড টাইমার হয়ে থাকেন,তবে অবশ্যই লিখাটা আপনার জন্য।পাশাপাশি লেখাটা সকল ফার্স্ট টাইমারদের জন্য যারা কিনা সেকেন্ড টাইমার হতে চাচ্ছেন।

একটা গল্প দিয়েই শুরু করি।বলছি একটা ছেলের কথা।দক্ষিণবঙ্গের প্রত্যন্ত কোনো এক জেলা থেকে ঢাকায় সে এসেছিল উন্নত শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্র তৈরি করতে।বাবার ইচ্ছায় মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন পূরণের লক্ষে তাকে এক গাদা টাকা খরচ করে ভর্তি হতে হয়েছিল নামিদামি এক কোচিং সেন্টারে।গ্রামের প্রকৃতির মাঝে থেকে হঠাৎ করেই ইট পাথরের শহরে তার পদচারণা।মাঝে মাঝে সে একা একা গ্রামের ফিল নিতে পার্কে হাটতে গিয়ে মানিব্যাগ-মোবাইল হারিয়ে ফেলে।বাবাকে বলতে গিয়ে ১০০ বার ভাবে নতুন মোবাইলের টাকা আদৌ দিতে পারবেন তো তিনি?এভাবে অনেক অভিজ্ঞতার মাঝে সে ভর্তি পরীক্ষার সমক্ষিণ হয়।ভাগ্যের দখিণা বাতাস তার জানালায় প্রবেশ করে নি।স্বপ্নটা তার বাস্তবায়ন হয়েও হয়নি,কেননা সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েছে বটে তবে সেটা তার স্বপ্নের সাবজেক্ট নয়।দিশাহারা বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কেননা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য সে।এতগুলো টাকার পুনরায় জোগান দিয়ে পড়ানোর সামর্থ্য ছেলেটার বাবার কাছে নেই।অগত্যা সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র হয় সে।
সাবজেক্ট ভালো নয়,ভবিষ্যৎ অনেকটা অনুজ্জ্বল, কেননা বাংলাদেশের চাকুরীর বাজারে ওকে অনেক স্ট্রাগল করতেই হবে।অনেক টেনশনে জর্জরিত ছেলেটা অবশেষে ক্লাসে যাওয়া শুরু করে।দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেন্ডের কালোহাত থেকে সে রেহাই পায় না।একের পর এক এক্সট্রিম র্যাগিংয়ের স্বীকার হয় ছেলেটা।নিত্যনতুন স্টাইলে সিনিয়রদের বিনোদন দেয়া,নুড হয়ে ছবি তুলে দেখানো,বিভিন্ন এক্সপ্রেশন দেবার এক্সাম্পল দেখানো,শীতের মাঝে পুকুরে নেমে এক দের ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া,বড় ভাইয়ের কাপড় ধুয়ে দেয়া,কথা না মানলে শারীরিকভাবে নির্যাতন সহ্য করা,থাপ্পড় সহ্য করা,হাত পা মেসেজ করে দেয়া ইত্যাদি করার পরেও ছেলেটা যখন কথিত খ্যাত হয়েই থাকে তখন সিনিয়দের সেই বুনো উল্লাস তার কাছে বিষাক্ত সাপের ছোবলের মত লাগে।প্রতিদিন গভীর রাতে বাথরুমের ট্যাপ ছেড়ে পানির সাথে চোখের পানিটাও এক হতে থাকে।তবুও সে সহ্য করে,কেননা সে মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিশাপ।একপর্যায়ে তাকে মানুষিক থেকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়।এবার ছেলেটার কন্ট্রোল লিমিট ১০৪ ডিগ্রি জ্বরের স্কেল কে অতিক্রম করে। এমতাবস্থায় কালো মেঘে ঢাকা ছেলেটার আকাশে বৃষ্টির ফোঁটা জমে।একাকী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গ্রামের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।ক্রিকেট,গোল্লাছু­ট,ফুটবল,বৃষ্টির মাঝে আমি কুড়ানো এসব ভীষন ভাবে মিস করতে থাকে ছেলেটা।এক পর্যায়ে ছেলেটার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।এই ছেলেটা গ্রামের মাটির ছেলে,যাকে তার মা কোনোদিনই একটি থাপ্পড় দেয় নাই।ইমোশন্স, রাগ, অভিমান সব এক দড়িতে মিশে যখন তাকে ফাঁশ দিতে উদ্ধত হয়,তখন সে তার মাকে ফোন দিয়ে ভাঙা গলায় কান্নার রোলে সব বলে,আফসোস!হতভাগার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু তার মা,তাই সব শেয়ার করে মায়ের সাথে।মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী মমতাময়ী মা,পারে না ছেলের কষ্টটা সহ্য করতে,আবার পারে না ছেলেকে বাসায় নিয়ে আসতে।অগত্যা মায়ের মুখে থেকে বের হয় অগ্নিস্ফুলাঙ্গ যা ছেলেটার জন্য বিষের মত।মায়ের কাছে আজ ছেলেটা দোষী।মা বলতে পারেনা অভাবের কথা,বলতে পারে না-"বাবা,বাড়ি ফিরে আয়, আমার ছেলেকে আর কান্না করতে দিব না আমি।"
অসহায় ছেলেটা ক্লাস চালিয়েই যায়।ক্যাম্পাসে হবু ইঞ্জিনিয়ার দের দেখে,মাঝে মাঝে ওদের একেকজনের ভাব,এরোগ্যান্ট স্বভাব ছেলেটাকে খুবই বিমর্ষ করে তোলে।ইঞ্জিনিয়ার রা তাকে প্রতিটা কথায় ইনসাল্ট করে,সায়েন্সের 'স'-ও সে বুঝে না,তার যোগ্যতা নেই এখানে আসার,তাদের সাথে মিশার।ওদের কাছে নগন্য একজন খারাপ ছাত্র সে,এবার সহসাই ছেলে টার মনে স্বপ্ন দোলা দেয়,আরেকটা সুযোগ হাতছানি দিয়ে ডাকে।তাই সিদ্ধান্ত নেয় সেকেন্ড টাইমার হবে।আবার পরীক্ষা দিবে,নিজেকে গড়বে, পরিবারকে সাপোর্ট দিবে,বাবা মায়ের স্বপ্ন সার্থক করবে।পরিবারকে কিছুই জানায় না,কেননা তার বাবার সাধ্য নেই ছেলেকে আবার লাখ লাখ টাকা দেবার।প্রতিটা ইনসাল্ট,প্রতিটা কষ্ট,মা বাবার স্বপ্ন সব গুলোই এক একটা অনুপ্রেরণা এসে জমে লাভার মত হয়ে যায়।ছেলেটা পড়তে থাকে,তাকে যে সেকেন্ড টাইমে টিকতে হবে।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকে,উপন্যাস গুলোর যেমন হ্যাপি ইন্ডিং হয় সেকেন্ড টাইম ডিডিকেট দের ও হ্যাপি ইন্ডিং হয়,অবশেষে বাবা মার স্বপ্ন পূরণ হয়,ছেলেটাও পছন্দের সাবজেক্ট এ চান্স পায়।
কিন্তু,ঘটনার শেষ নয় এখানেই।
ছেলেটা এখানেও সেই পূর্বের মত র্যাগিংয়ের স্বীকার হয়,তবে এখন সে সহ্য করতে বাধ্য হয়,কারন তার অন্য কোনো পথ নেই।নতুন ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝেই স্কুলের কিংবা কলেজের বন্ধুদের সাথে দেখা হয়।একদিন সে এক বন্ধুকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলে-"দোস্ত,কেমন আছিস তুই,তুই এখানে, আমাকে আগে বলবি না?আমি অমুক ডিপার্টমেন্ট প্রথম বর্ষ।"কথাটা শেষ না হতেই,বন্ধুর পাশের কথিত বড় ভাই বেশ চড়াও হয়,বন্ধুকে বন্ধু বলার অপরাধে রাতভর বাসায় ডেকে নিয়ে আমেরিকান পাই -এর সকল পার্টের শো চলে।ইউনিভার্সিটি এর সাজানো নিয়মে সে তার স্কুলের বন্ধুর ছোট ভাই।এটাই তার জীবনের সব চেয়ে বড় অপরাধ।প্রতিটা বন্ধুকে বন্ধু ভাবতে মানা টাই বন্ধু ভাবতে ইচ্ছে করে তার।"কেউ কি আছে,যে বাল্যকালের বন্ধুকে ভাই বলতে বাধ্য করে?কেউ কি আছে যে বাল্যকালের বন্ধুকে সিনিয়রিটি দেখিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নেয়,কাপড় ধুয়ে নেয়,বাজার করতে দেয়?"-এসব প্রশ্নে সে জর্জরিত।মাঝে মাঝে পূর্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে পড়ে,হয়ত তাকে মারলেও এতটা কষ্ট পাবে না,যতটা কষ্ট বন্ধুকে ভাই বলতে পায়।এমতাবস্থায় কোনো উপায় জানা নেই তার কাছে,তবুও কষ্ট গুলো রবীন্দ্রনাথের সেই ঘাটের পানিতে ঘূর্ণিত পাতার মত বার বার মনে আঘাত করে।বাল্যকালের বন্ধু তাকে গালিগালাজ করে,অন্যদের মত র্যাগ দেবার সময় বুনো উল্লাসে মেতে উঠে।সবার অগোচরেও ভাইয়া বলতে বাধ্য করে।মানুষিক ভাবে হীন করে।তবুও তার একবারও মনে আসেনা বাল্যকালের কথা।যখন একসাথে ওরা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে রানের জন্য ছুটত,তার মনে পড়েনা, যখন পরীক্ষার হলে এই খ্যাতের কল্যানে সে পাশ করত।এসব মনেই আসে না,সব ভুলে গেছে,কারন সে দাবিকরা কথিত সিনিয়র।ছেলেটার দিন কাটছে, এভাবেই প্রতিনিয়ত কাটছে দিন।
গল্পের সব অংশ কোন এক বিশেষ ব্যক্তির থেকে শুনে লিখি নাই,জরিপ চালিয়ে করেছি কিছু কথা বলব বলে।আমার উদ্দেশ্য তাদেরকে একটা নোটিস দেয়া যারা এবার ফার্স্ট টাইম পরীক্ষা দিচ্ছেন।পারবেন নিজের বন্ধুকে ভাই বলে ডাকতে?বুকে হাত দিয়ে বলুন,পারবেন কি মেনে নিতে আপনার সমবয়সীরা আপনাকে নিয়ে মজা করে বুনো উল্লাসে মাতাতে?
আপনি মধ্যবিত্ত নন কি?
হ্যা, আপনাকেই বলছি,পারবেন কি ফার্স্ট চান্সে বাবা মার স্বপ্ন পূরণ করতে?মাথায় রাখবেন,আমরা সেই মধ্যবিত্ত যাদের নুন আনতে পান্থা ফুরায়,আমরা সেই মধ্যবিত্ত যাদের ক্লোজআপ টুথপেস্ট শেষ হয়ে গেলে সেটাকে কেটে কেটে তিন ভাগে ভাগ করে শেষ অংশবিশেষও বাদ রাখি না।জি ভাই,আমরা সেই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বলছি যে পরিবারের সন্তান ছিলেন পৃথিবীর নামি দামি মানুষগুলো।আমরা একাকী কান্না করতে জানি,আমরা বাবা মার অর্থের মূল্য দিতে জানি,আমরা সমাজের নির্মমতা জানি,আমরা সত্যিকারের পৃথিবীকে খুবই কাছে থেকে জানি।
পরিশেষে একটা কথা,আমি কখনোই সেকেন্ড টাইমারদের বিপক্ষে নই, তবে উপরের অবস্থার সমক্ষিণ ১০০ ছেলের ৬০-৭০ জনের কথা গুলো তুলে ধরেছি।আর এরা সবাই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত, স্বপ্নগুলো পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
সুতরাং,এখন থেকে পড়াশুনা শুরু করবেন।টার্গেট ফার্স্ট টাইম স্বপ্ন পূরণ।যদি এই হয় আপনার প্যাশন,তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোমাঞ্চকর জীবনে আপনাকে স্বাগতম।
- মুনিব ফুয়াদ মুরাদ

No comments:

Post a Comment